ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্ক নামের নতুন এক অর্থনৈতিক বলয়ে বাংলাদেশকে চায় যুক্তরাষ্ট্র। এজন্য তারা বাংলাদেশকে প্রস্তাব দিয়েছে। বাইডেন প্রশাসন কৌশলগত স্বার্থে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে এই চুক্তির উদ্যোগ নিয়েছে।

প্রথম পর্যায়ে ফ্রেমওয়ার্কে যুক্ত হওয়ার জন্য নয়টি দেশকে এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে বাংলাদেশসহ তিনটি দেশকে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

আজ বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে প্রসঙ্গটি উত্থাপন করতে পারে ওয়াশিংটন। দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছরপূর্তি উদযাপনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন যুক্তরাষ্ট্র সফরে গেছেন।

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের সঙ্গে আজ তার বৈঠক হবে। বৈঠকে বাংলাদেশের তরফে র‌্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের অনুরোধ জানানো হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র তাদের প্রস্তাবিত দু’টি সামরিক চুক্তি-আকসা ও জিসোমিয়া সই করার অগ্রগতি জানতে চাইতে পারে।

ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফ্রেকওয়ার্ক নিয়েও আলোচনা হতে পারে। পাশাপাশি, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ইউক্রেনে মানবিক সহায়তা সংক্রান্ত প্রস্তাবের পক্ষে বাংলাদেশ ভোট দেওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করতে পারে। একই সঙ্গে আগামীতে রুশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের অবস্থান চাইতে পারে যুক্তরাষ্ট্র।

বাইডেন প্রশাসন প্রথম পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া ও অস্ট্র্রেলিয়ার সমন্বয়ে অর্থনৈতিক বলয়ের যাত্রা শুরু করতে চাইছে।

দ্বিতীয় পর্যায়ে থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন ও বাংলাদেশকে ফ্রেমওয়ার্কে যুক্ত হওয়ার প্রস্তাবও দিয়ে রেখেছে। এখনও চলছে ফ্রেমওয়ার্ক প্রণয়নের কাজ। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের প্রভাব মোকাবিলায় এমন উদ্যোগ বলে অনেকের ধারণা।

চীনের সামরিক প্রভাব মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে আগেই কোয়াড নামের জোট করা হয়েছে। কোয়াডে জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারত অন্তর্ভুক্ত থাকলেও অনেক দেশই এমন সামরিক জোটে যেতে চাইছে না।

চীন কোয়াডে যোগদানের বিরুদ্ধে কড়া হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করলেও ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্ক সম্পর্কে কিছুই বলেনি।

সূত্র মতে, এই অর্থনৈতিক বলয়ের ব্যাপারে নিবিড় পর্যবেক্ষণ করছে চীন। যুক্তরাষ্ট্র ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্কের কাঠামো ঘোষণার পর চীন প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির ব্যাপারে বাংলাদেশের কিছু নীতিগত অবস্থান রয়েছে। প্রথমত বাংলাদেশ কোনো দেশের বিরুদ্ধে গঠিত জোটে যোগ দেয় না। ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিতেও সামরিক অংশে যোগ দিতে বাংলাদেশের আপত্তি রয়েছে।

এ কারণে কোয়াডে যোগ দেবে না বাংলাদেশ। তবে অর্থনৈতিক সহযোগিতার ব্যাপারে বাংলাদেশের আপত্তি নেই। ফলে নীতিগত দিক থেকে ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্কে যোগ দিতে বাংলাদেশের বিবেচ্য বিষয় হলো, এই বলয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের লাভ কতটা হবে।

আজকের বৈঠকে এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের তরফে বাংলাদেশের অভিমত জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফ্রেমওয়ার্ক সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য চাইবে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত ফেমওয়ার্কের ব্যাপারে বাংলাদেশ কতিপয় বিবেচ্য বিষয় নির্ধারণ করেছে।

সূত্র মতে, ফ্রেমওয়ার্কের চারটি উপাদানের মধ্যে যেগুলোতে বাংলাদেশের স্বার্থ জড়িত ওইসব উপাংশেই শুধু বাংলাদেশ যোগ দেবে। শুধু যুক্তরাষ্ট্রের নীতি ও লক্ষ্য বাস্তবায়নে বাংলাদেশ হাতিয়ার হবে না।

সূত্রটি আরও জানায়, মুক্ত বাণিজ্য চাইলেও বাংলাদেশ এই ফ্রেমওয়ার্কে মূলত অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা চাইবে। বিশেষ করে বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে বাজার সুবিধা আরও উন্মুক্ত করার প্রতি জোর দেবে ঢাকা।

চীনের নেতৃত্বে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) নামের একই ধরনের একটি উদ্যোগে বাংলাদেশ যোগ দিয়েছে। বিআরআই বাংলাদেশের বিভিন্ন অবকাঠামো প্রকল্পে বিপুল অংকের ঋণ দিয়েছে।

সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন বলেছেন, ‘বাংলাদেশের জনগণের জীবনমানের উন্নয়নের জন্য অবকাঠামোসহ বিভিন্ন খাতে প্রচুর অর্থায়ন প্রয়োজন। চীন অর্থের ঝুড়ি নিয়ে হাজির। এখন আমাদের কী করা উচিত?’

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই ইঙ্গিতই করেছেন যে, জনগণের জীবনমানের উন্নয়নের লক্ষ্যে পশ্চিমা অর্থ, বাণিজ্য, বিনিয়োগ বাংলাদেশের প্রয়োজন। কিন্তু চাহিদা মতো অর্থের প্রবাহ নেই।

এশীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক জোরদারের মাধ্যম হিসাবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ২০২১ সালের অক্টোবরে ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্ক ঘোষণা করেন।

যদিও এই নতুন অর্থনৈতিক বলয়ের ব্যাপারে কার্যকর আলোচনা এখনো শুরু হয়নি। বাংলাদেশকে প্রাথমিকভাবে এই ফ্রেমওয়ার্কের ব্যাপারে ব্রিফ করেছে যুক্তরাষ্ট্র।

কয়েক বছর ধরে আলাপ-আলোচনা করে ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্র ১২টি দেশ নিয়ে ‘ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ’ (টিপিপি) সই করে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ওই চুক্তি থেকে বেরিয়ে এলে যুক্তরাষ্ট্রবাদে অন্য দেশগুলো চুক্তি করে।

বাইডেন ক্ষমতায় যাওয়ার পর অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক বিষয়ে এশিয়ার সঙ্গে পুনরায় যুক্ত হওয়ার চাপ সৃষ্টির প্রেক্ষাপটে ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্ক গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়।

বাণিজ্য ক্ষেত্রে বাইডেন প্রশাসন নতুন ফ্রেমওয়ার্কে টিপিপি থেকে শ্রমমানের উন্নয়ন, টেকসই পরিবেশ, ডিজিটাল অর্থনীতিতে সহযোগিতার বিষয় অন্তর্ভুক্ত করেছে।

এ ছাড়া টেকসই খাদ্যব্যবস্থা এবং বিজ্ঞানভিত্তিক কৃষির নিয়ম-কানুন, স্বচ্ছতা এবং সুস্থ নিয়ম চর্চা, প্রতিযোগিতার নীতি, বাণিজ্য সহায়তাও রয়েছে এর মধ্যে।

এর বাইরে সরবরাহ চেইন, অবকাঠামো, কার্বনমুক্ত ক্লিন এনার্জি, কর এবং দুর্নীতি দমনকে নতুন করে অন্তর্ভুক্ত করেছে বাইডেন প্রশাসন।

বাইডেন প্রশাসন এটাও ঘোষণা করেছে যে, ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্ক হবে এশীয় অঞ্চলের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যনীতি।

বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে অংশীদারি সংলাপে ইন্দো-প্যাসিফিক ফ্রেমওয়ার্ক নিয়ে কিছুটা আলোকপাত হলেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে আবারও প্রসঙ্গটি তুলতে পারে যুক্তরাষ্ট্র।

এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের তরফে বিষয়টি নিয়ে দুই দেশের আসন্ন অর্থনৈতিক সংলাপে আলোচনার প্রস্তাব দেয়া হতে পারে। জুনে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক সংলাপ হওয়ার কথা রয়েছে।

অপর দিকে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে বৈঠকের পরপরই ৬ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সংলাপ অনুষ্ঠিত হবে।

 

 

কলমকথা/ বিথী